1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

সুমন ব্যানার্জি : সাহিত্য চেতনা



শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়'র ছোটগল্পে বুদ্ধের প্রত্নপ্রতিমার পুনর্নির্মাণ 

                     •   সুমন ব্যানার্জি

                                ***


১.

   একটি প্রাচীন মিথ, কিংবদন্তি নানা মাত্রায় পুনর্নির্মিত/বিনির্মিত হয় পরবর্তী সময়ের সাহিত্যে।একটি মিথ আসলে বহন করে ধর্ম-নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জানাকে।তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে গল্প, কাহিনী বা উপকাহিনীর মধ্যে দিয়ে মিথ, কিংবদন্তি ইত্যাদি পরিবেশিত হয় আবার কখন তা লোকশ্রুতির মধ্যে দিয়েও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়।কাজেই এর শিকড় নিহিত থাকে এক বিরাট সাংস্কৃতিক পরিসরে,জনমানসের যৌথ নির্জ্ঞানে।

    বাংলা সাহিত্যে ও সাংস্কৃতির সুদীর্ঘ সম্ভ্রান্ত ইতিহাসে মিথ, কিংবদন্তি,পুরাণের ভাঙা-গড়া, নির্মাণ বা পুনঃ নির্মাণ চলেছে সুদূর ষোড়শ শতক থেকেই।ভারতীয় সাহিত্যের প্রধান তিনটি ধারা যথা - বৈদিক, ঔপনিষদিক ও বৌদ্ধ এবং পৌরাণিক অধিবাসিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে।এর পাশাপাশি শাক্ত ও বৈষ্ণবের মত দুটি উল্লেখযোগ্য স্রোত তো আছেই।ঊনবিংশ শতকের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মধুসূদন দত্তের গোটা সাহিত্য কীর্তির মূল শিকড় প্রোথিত মিথ ও পৌরাণিক ঐতিহ্যে।আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের এক অতুল কীর্তির কথাকোবিদ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অনন্যোপম ঐতিহাসিক সাহিত্যের মধ্যে মিথ, কিংবদন্তি,পুরাণ,ইতিহাস, প্রত্নস্মৃতি ইত্যাদি সমস্ত উপাদানকেই অসামান্য মুন্সিয়ানায় ব্যবহার করেছেন।তন্মধ্যে সরাসরি বুদ্ধের জীবন,দর্শন ও প্রত্নপ্রতিমা/কল্প নিয়ে লেখা গল্পগুলি।তিনি এই বিষয় আধারিত তিনটি গল্প লেখেন যথা - অমিতাভ, চন্দন-মূর্তি ও মরু ও সঙ্ঘ।এই গল্পত্রয় নিয়ে আলোচনাই এই প্রবন্ধের মূল অন্বিষ্ট।


      অমিতাভ :

    অমিতাভ' গল্পটির সময়কাল হল খৃঃপূঃ ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী।এই গল্পের কথক নিজেকে জাতিস্মর বলে কল্পনা করেছেন।ধূম্র-কুন্ডলীর মত বর্তমান জগত অপসৃয়মান হয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে এক মায়ার জগত।প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এক স্বপ্ন তিনি দেখছেন - "এক পুরুষ - ভারত আজ তাঁহাকে ভুলিয়া গিয়াছে - তাঁহার কোটিচন্দ্রস্নিগ্ধ মুখপ্রভা এই নশ্বর নয়নে দেখিতেছি, আর অন্তরের অন্তস্তল হইতে আপনি উৎসারিত হইতেছে...সেই জ্যোতির্ময় পুরুষকে একদিন দুই চক্ষু ভরিয়া দেখিয়াছিলাম - তাঁহার কন্ঠস্বর শুনিয়াছিলাম - আজ সেই কথা জন্মান্তরের স্মৃতি হইতে উদ্ধৃত করিব।"

     গল্পে কথক হলেন শ্রেণিনায়ক কুমারদত্ত।তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন পরিব্রাজিকা।সে কুমারদত্তকে একটি সনাল পদ্ম দিয়ে বলে গেলেন যে ফুলের কোরকে কিছু উপদেশ আছে। অর্থাৎ সাংকেতিক ভাবে কিছু লেখা আছে।যা কাজ হয়ে যাবার পর বিনষ্ট করে দেওয়া উচিত।এরপর শ্রেণিনায়ক দেখলেন যে সত্যিই সেখানে কাজল দিয়ে লেখা আছে যে আজ মধ্যরাতে একা মহামন্ত্রীর কাছে যেতে হবে।সংকেত মন্ত্র 'কুটমল'।এবং লিপির নিম্নে ছিল মগধেশ্বরের মুদ্রা।তারপর যথারীতি মহামাত্যের সঙ্গে সাক্ষাতে গেলেন।চারিদিকে গুপ্তচর ঘুরছে তাই আনীত সেই পদ্ম কোরক তাকে খেয়ে নিতে বলল।কিছুক্ষণ পর তাঁর অধীনে কত কর্মিক,স্থপতি,সূত্রধার,তক্ষক ও ভাস্কর আছে মহামাত্য জানতে চাইল এবং সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে নিশ্চিন্ত হল।তাঁর ওপর দুর্গ নির্মাণের মহা দায়িত্ব অর্পিত হল পূর্বে ভাগীরথী ও হিরণ্যবাহুর সংগমে।সেই সময় ছিল বর্ষাকাল এরপর শরৎ কালেই কোশল ও বৃজির সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে।তিনমাসের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে নতুবা তাঁর শিরোচ্ছেদ হবে -এই অঙ্গীকারবদ্ধ হল সে।কাজেই দুধর্ষ শত্রু পক্ষের সঙ্গে সমাগত যুদ্ধের প্রাক্- প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এই দুর্গ নির্মাণ।বলা বাহুল্য যে 'মগধের গগনলেহী দুর্গচূড়া' শত্রু পক্ষের মানসিক বলে চিড় ধরিয়ে স্বীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি প্রতীক।মহামাত্য তাঁকে বলল যে যাত্রা করার সময় যদি কোন ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন মনে হয় তৎক্ষণাৎ তাকে হত্যা করতে।রাজ নির্দেশ পালন করা ছাড়া তাঁর আর কোন কাজ থাকতে পারে না।ভোরবেলা যখন তাঁকে মহামাত্য বিদায় দেবেন সেইসময় তাঁকে তৎকালীন আরো একটি বিপদ সম্পর্কে সচেতন করেদিল তা হল বুদ্ধ ও বৌদ্ধদের সম্বন্ধে।বিম্বিসার বুদ্ধানুরাগী হলেও চরম বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন অজাতশত্রু।কাজেই অতিচতুর, ব্রাহ্মণবিরোধী একটি নাস্তিক ধর্ম হিসাবেই তাচ্ছিল্য করা হত।যাঁদের চোখে বুদ্ধদেব ছিলেন - "শাক্যবংশের এক রাজ্যভ্রষ্ট যুবরাজ...অতিশয় ধূর্ত,কপটী ও পরস্বলুব্ধ।"এদের দেখা মাত্রই 'নির্দয়ভাবে হত্যা' করার নির্দেশ দেওয়া হল।যে বুদ্ধ গোটা মানবজাতিকে এক নতুন পথ রেখার সন্ধান দেবেন তাঁর সম্বন্ধেই এমন বিদ্বেষ দেখে বিস্মিত হতে হয়।কালের এমনই কুটিল গতি যে 'পাটলিপুত্র-রচয়িতা মগধের পরাক্রান্ত মহামন্ত্রী' বর্ষকারকে ইতিহাস মনে রাখেনি কিন্তু মনে রেখেছে শাক্য বংশের 'রাজ্যভ্রষ্ট যুবরাজ'কে যাঁর নাম 'অর্ধেক এশিয়া' জপ করছে, 'অনির্বাণ শিখার ন্যায় তমসান্ধ মানবকে জ্যোতির পথ নির্দেশ করিতেছে।'

    দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করার জন্য উত্তর ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত সবাই এসে পৌঁছেছে।গভীর রাতে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে এমন সময় একজন সন্দেহভাজন সন্ন্যাসীকে ধরে আনেন।তিনি নানা রকম ভবিষ্যৎবাণী করতে লাগছেন কিন্তু বাস্তবিক তিনি ছিলেন একজন প্রবঞ্চক তা দিঙনাগ ধরে ফেলেছিল।তিনি পেটের দায়ে এইসব কাজ করতেন।তখন মহামন্ত্রীর সেই আগাম সতর্ক বার্তা শ্রেণিনায়কের সত্য বলে মনে হল।যে এ হয়তো কোন ঠক বৌদ্ধ শ্রমণ।তাঁকে বেঁধে রাখা হল।ঠিক হল পরদিন এই ভন্ড তপস্বীকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হবে।শ্রেণিনায়ক বলল এর ফলে একসঙ্গে দু'টি কাজ হবে যথা শত্রু নিপাত অন্যদিকে দেবতুষ্টি।দিঙনাগ পরামর্শ দিল যে বলিকে সুরা পান করিয়ে অচৈতন্য করে দেওয়ার পর কানে কানে বলা হবে যে 'তুমি চিরদিন প্রেতদেহে এই দুর্গ রক্ষা করিতে থাক'।এরপর তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই তপস্বী আত্মঘাতী হয় বিষ খেয়ে।অন্যদিকে বলি দেওয়ার মানস করা হয়েছে দেবতার কাছে কাজেই বলি না পেয়ে অসন্তুষ্ট হতে পারেন - ভীত হল অনেকেই।ঠিক এই সময় কয়েকজন মুন্ডিত-মস্তক ভিখারীকে ছাউনিতে আশ্রয় সন্ধান করছিল তাঁদের ধরে আনে প্রহরী।দিঙনাগ অত্যন্ত উজ্জীবিত হল।সে মহানন্দে চিৎকার করে বলল যে "জয় রুদ্রেশ্বর,জয় ভৈরব !...নায়ক, দেবতা স্বয়ং বলি পাঠাইয়াছেন !" এই চার-পাঁচজন ভিখারীর মধ্যে একজনেরই বয়স সত্তর অতিক্রম করেছে।সে যখন ভয়হীনভাবে স্মিত হেসে বলল 'মঙ্গল হউক' তখনই এক মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল।সেই বৃদ্ধের মুখ মন্ডলে এমন এক অনির্বাচিত জ্যোতি যা অন্তরাত্মাকে তড়িৎস্পৃষ্টের মত জাগিয়ে তুলল।শ্রেণিনায়ক মনে মনে ভাবল যে - "কে ইনি ?এত সুন্দর, এত মধুর, এত করুণাসিক্ত মুখকান্তি তো মানুষের কখনও দেখি নাই।দেবতার মুখে যে জ্যোতির্মন্ডল কল্পনা করিয়াছি, আজ বৃদ্ধের মুখে তাহা প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম।" যেন এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে চোখে মুখে কিন্তু তা মানুষকে দহন করে না প্রদান করে এক অপার্থিব স্নিগ্ধতা,প্রশান্তি।শ্রেণি নায়কের মনোলোকে একটিই শব্দ রণিত হচ্ছে 'অমিতাভ'।

    সেই বৃদ্ধ জানাল যে সে যাযাবর ভিক্ষু,কুশীনগর যেতে চায়।তাই আজ রাতের জন্য আশ্রয় চায়।এরপর তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে চাওয়ায় জনৈক সহচর বলল শাক্য সিংহ গৌতমের নাম শোনেননি।সে বিস্ময়াভিভূত হল যে ইনিই বুদ্ধ ! যাকে মহামাত্য শুধু ধূর্ত,কপটী, পরস্বলুব্ধই বলেননি নির্দয়ভাবে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল।শ্রেণিনায়কের মনে তখন সব ওলটপালট হয়ে গেছে শাক্য সিংহকে দেখেই।সে অনেক মানুষ দেখেছে কিন্তু এমন মানুষ তো কখন দেখেনি।মহামাত্যের কথা ভেবে তার করুণা হল যে সে কখন দেখেনি শাক্যসিংহকে। তাঁর সমস্ত আত্মাভিমান,অন্ধত্ব,মোহ মুহূর্তের মধ্যে দূরীভূত হল।সে শরণাগত হয়ে বলল যে - "অমিতাভ, আমি অন্ধ, আমাকে চক্ষু দাও,আমাকে আলোকের পথ দেখাইয়া দাও।" যে দুর্ধর্ষ,নিষ্করুণ দিঙনাগ বলি দেবার কথা ভেবেছিল সে কাঁদতে শুরু করল।ভূমিকম্পের মত অতীত জীবন ধূলিসাৎ হয়ে এক নতুন আলোর পৃথিবীতে তাঁরা প্রবেশ করল।কীট থেকে মানুষ্যবোধে উদ্বোধিত হল।পরদিন সকালে যখন বুদ্ধ কুশীনগর অভিমুখে পাড়ি দেবেন তখন শ্রেণি নায়কের হাত ধরে বলে গেলেন এক শাশ্বত সত্য - "হিংসায় হিংসার ক্ষয় হয় না, বৃদ্ধি হয়।"


২.

   চন্দন-মূর্তি :

    

       এই গল্পের কেন্দ্রে আছেন অভিরাম নামক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু।লেখক তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধ শিল্পকলা নিয়ে আলোচনার সময় এক অনন্য প্রশ্ন তিনি উত্থাপন করেন।বুদ্ধ যখন জীবিত তখন তার মূর্তি কেউ নির্মাণ করেনি। তাঁর দেহান্তরের কয়েকশো বছর পর যে মূর্তি নির্মিত হয় তাই কি বুদ্ধের প্রকৃত মূর্তি ?বুদ্ধ মূর্তির প্রকৃত সূচনা বুদ্ধের নির্বাণের প্রায় পাঁচশত বছর পর খৃষ্টীয় চতুর্থ শতকে।তিনি বলেন যে -"ভারতে ও ভারতের বাইরে কোটি কোটি বুদ্ধমূর্তি আছে। কিন্তু সবগুলিই তাঁর ভাব-মূর্তি।ভক্ত-শিল্পী যে-ভাবে ভগবান তথাগতকে কল্পনা করেছে, পাথর কেটে তাঁর সেই মূর্তিই গড়েছে। বুদ্ধের সত্যিকারের আকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না।" আসলে বুদ্ধের আবির্ভাব, তাঁর অনন্যোপম বাণী, আত্মত্যাগ,যোগৈশ্বর্য মানুষের মনোজগতকে শুধু আলোড়িতই করেনি বিপুল ভাবান্তর ঘটিয়ে ছিল।আবালবৃদ্ধবণিতা জাতিধর্মবর্ণভাষা নির্বিশেষে মানুষ তাঁর শরণাগত হয়েছিল।তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁর ভাবমূর্তি মানব মনে রেখায়িত হয়ে অম্লান হয়ে আছে।এই প্রসঙ্গে লেখক অভিরাম'র কথাকে সম্মতি জানিয়ে এক শাশ্বত সত্যকে অনাবৃত করলেন - "হ্যাঁ, মানুষের স্মৃতির উপর যাদের কোনও দাবি নেই তারাই পাথরে নিজেদের প্রতিমূর্তি খোদাই করিয়ে রেখে গেছে, আর যাঁরা মহাপুরুষ তাঁরা কেবল মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমর হয়ে আছেন।এই দেখুন না, যীশুখ্রীস্টের প্রকৃত চেহারা কি রকম ছিল তার কেউ জানে না।"

    এই অভিরাম চাক্ষুষ করতে চেয়েছিলেন বুদ্ধের প্রকৃত অবয়ব। তাঁর মন সব সময় চায় আড়াই হাজার বছরের সেই দিব্য পুরুষের জ্যোতির্ময় রূপ দেখতে‌।একদিন বলেছিল যে সে নাকি বুদ্ধের জন্য,কেশ,নখ দেখেছে।সে এও বলেছিল যে - " 'গৌতম ! তথাগত !আমি অর্হত্ত্ব চাই না, নির্বাণ চাই না, -- একবার তোমার স্বরূপ আমাকে দেখাও।যে দেহে তুমি এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে সেই দেব-দেহ আমাকে দেখাও।…" স্রষ্টা সব সময় রূপকে খোঁজে নিরাকারকে নয়।মানবদেহ রূপী বুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করার জন্য সে মোক্ষকেও তুচ্ছ মনে করেছে।এখানেই শরদিন্দুর অনন্যতা শিল্পী হিসাবে।লেখক একদিন ফা-হিয়েন'র ভ্রমণ-বৃত্তান্তের পাতা ওল্টাতে গিয়ে সন্ধান পান জেতবন বিহারের কথা।কথিত আছে যে বুদ্ধ স্বর্গে গমন করে তাঁর মা'র হিতার্থে নব্বই দিন ধর্ম প্রচার করেন।তখন রাজা প্রসেনজিৎ গোশীর্ষ চন্দন কাঠের একটি মূর্তি স্থাপন করেন। বুদ্ধ স্বর্গ থেকে নেমে এসে ঐ মূর্তি বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য স্বস্থান পরিত্যাগ করে।ঐ মূর্তির উদ্দেশে বুদ্ধ বলেন যে - "তুমি স্বস্থানে প্রতিগমন কর ; আমার নির্বাণ লাভ হইলে তুমি আমার চতুর্বর্গ শিষ্যের নিকটে আদর্শ হইবে।" এই মূর্তিই বুদ্ধের সর্বাপেক্ষা প্রথম মূর্তি। কিন্তু বুদ্ধের নির্বাণের পর জেতবন বিহার ভস্মীভূত হয়।অনেকেই আক্ষেপ করেন এই মর্মে যে চন্দন-মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু চার-পাঁচ দিন পর পর পূর্বপার্শ্বস্থ ক্ষুদ্র বিহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় ও সেই মূর্তি দেখা যায়।এই কথা শুনে বিস্ময়াভিভূত হন অভিরাম ও দর্শনের জন্য আকুল হয়ে ওঠেন।

    একটি শিলালিপি থেকে সেই প্রাচীন বিহারের কথা জানতে পেরে দু'জনে সেখানে পাড়ি দেয়।সেখানে এও লেখা আছে যে তুরস্কের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য শ্রমণগণ চন্দন-মূর্তি গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে রাখে।মোড়ল বলল যে গ্রাম থেকে চার ক্রোশ উত্তরে উপলা নদীর প্রপাত।প্রপাতের ঠিক মুখে একটি পর্বত শৃঙ্গ আছে যা বুদ্ধস্তম্ভ নামে খ্যাত। গ্রামবাসীরা পূর্ণিমার রাতে ওখানে পূজা দেয়। স্মরণাতীত কাল থেকে চালু প্রবাদ আছে যে বুদ্ধদেব সশরীরে এই স্তম্ভ শীর্ষে অবস্থান করেন এবং তাঁর গাত্র থেকে চন্দনের গন্ধ নির্গত হয়।পাঁচ হাজার বছর পর আবার মৈত্রেয় রূপ ধারণ করে তিনি এই স্থান থেকে বার হবেন।অনেক পথ অতিক্রম করে যখন তাঁরা গোশীর্ষের সামনে পৌঁছলেন তখন হঠাৎ প্রচন্ড ভূমিকম্পন শুরু হল।দেখা গেল সেই শীর্ষ মাস্তুলের মত দুলছে। ভূমিকম্পের তীব্রতা আরও বাড়ল।দেখা গেল যে শীর্ষটি মূল থেকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।এরপর সেই অভিরাম'কে দেখা গেল 'অনির্বচনীয় আনন্দে' তাঁর মুখ উদ্ভাসিত ফলত চারিদিকে যে প্রলয় চলছে সেই ব্যাপারে তাঁর কোন হুঁশ নেই। অর্থাৎ সে যেন বাহ্য চেতনা শূন্য !সে খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

    এরপর লেখক একাকীই প্রত্যাবর্তন করেন।তিনি জানেন না যে তাঁর বুদ্ধকে সশরীরে দেখার ঐকান্তিক অদ্বিতীয় অভীপ্সা পরিপূর্ণ হয়েছে কিনা বা সে এখনও জীবিত কিনা ? কিন্তু তাঁর অনুসন্ধান যে সফল হয়েছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। শরদিন্দু গল্পটি শেষ করলেন এইভাবে যে - 'মৃত্যুমুহূর্তে তাঁহার মুখের উদ্ভাসিত আনন্দ আজও আমার চোখের সম্মুখে ভাসিয়েছে।'এই 'মৃত্যু' নিছক পার্থিব অর্থে অবশেষ নয় , নতুন কিছুর শুরু।এই রহস্যমেদুরতা,অপূর্ণতা, অতৃপ্তিই যে কোন শিল্পীর সৃষ্টি চেতনার মূলে।ছোটগল্প সুলভ অতৃপ্তির রেশ রেখেই তিনি যবনিকাপাত ঘটালেন।


৩.

 মরু ও সঙ্ঘ :

 

    মরু ও সঙ্ঘ গল্পে শরদিন্দু এক অসামান্য রোম্যান্টিক জীবনশিল্পী।এই গল্পের পটভূমি হল মধ্য-এশিয়ার দিকসীমাহীন মরুভূমি। একদিন প্রচন্ড ঝড়ে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ সঙ্ঘ ঢাকা পড়ে গেল।প্রাণ বাঁচিয়ে দু'জন ব্যক্তি বেরিয়ে এল একজন সঙ্ঘ স্থবির পিথুমিত্ত ও দ্বিতীয় জন উচন্ড।এই সঙ্ঘের পাদমূলে খেঁজুরকুঞ্জের মধ্যে একটি প্রস্রবণ ছিল সেখানে দু'জন গিয়ে দেখতে পেলেন গুহা মধ্যে বালুকা সিক্ত পিকচার মধ্যে দু'জন মানবশিশু।একজনের বয়স পাঁচ কি ছয় ও অন্যজন দেড় বছরের বালিকা।জন কোলাহল থেকে দূরবর্তী স্থানে দু'জন সমবয়সী ছেলে মেয়ে একসঙ্গে বড় হবার ফলে পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠে স্বাভাবিক নিয়মেই।একদিকে বিশ্ব প্রকৃতির সেই অপার সৌন্দর্যের আকর্ষণ ও অন্য দিকে বয়ঃসন্ধিকালে অন্তর্জগতে শুরু হয় প্রচণ্ড মন্থন - "...ইতি দিগন্তের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, 'ঐ দেখ।'

অঙ্গুলির নির্দেশ অনুসরণ করিয়া নির্বাণ সহসা বিস্ময়ে নিস্পন্দ হইয়া গেল।দূরে দিগন্তরেখা যেখানে আকাশে মিশিয়াছে সেইখানে একটি হরিদ্বর্ণ উদ্যান -- শ্যামল তরুশ্রেণী বাতাসে আন্দোলিত হইতেছে...একটি নদী এই নয়নাভিরাম শ্যামলতার বুক চিরিয়া খরধার তরবারির মতো পড়িয়া আছে।…

ইতি কিন্তু উত্তেজনার আতিশয্যে নির্বাণের গলা বাহুবেষ্টিত করিয়া প্রায় ঝুলিয়ে পড়িল,মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া হাঁপাইতে বলিল, 'দেখিতেছি ?নির্বাণ, দেখিতেছি ?কি সুন্দর !চল, আমরা দুইজনে এখানে চলিয়া যাই।আর কেহ থাকিবে না, শুধু তুমি আর আমি।--চল, চল নির্বাণ।' "

    কিন্তু দু'জন নরনারীর এই ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারেনি উচন্ড।কারণ সে সঙ্ঘের নিয়ম ও অনুশাসন পালনে কোন শৈথিল্যকে প্রশ্রয় দিতে চায়নি।নির্বাণ'কে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল যে যাঁর অন্তরে প্রকৃত ত্যাগ ও বৈরাগ্য জন্মেছে সেইই সঙ্ঘে থাকার যোগ্য।নির্বাণ'কে উপসম্পদা দান করা হল এবং তিনদিনের জন্য সে পরিবেণে প্রবেশ করল।সে এখন বৌদ্ধ ভিক্ষু তাই সারাদিন নিমগ্ন থাকে পুঁথি অধ্যয়নে। তাঁর উচন্ড'র সান্নিধ্যে বেশিরভাগ সময় কাটে।এদিকে ইতি একা হয়ে যায়।সে নানা অছিলায় যেতে চায় নির্বাণের কাছে।উচন্ড'র মূল অভীষ্ট হল দু'জনের মধ্যে চিরবিচ্ছেদ ঘটানো। কিন্তু সে বুঝতে পারে যে নির্বাণের মনে সংশয়,দ্বন্দ্ব প্রবল হচ্ছে। তাঁকে কোন সঙ্ঘের কঠোর নিয়মে বেঁধে ফেলা যাচ্ছে না।উচন্ডের মনের এই তীব্র চাপা অসন্তোষ থেকে সে নিবিড়ভাবে নিজের অজ্ঞাতেই নির্বাচনকে ঘৃণা করতে শুরু করল।যা আসলে এক প্রকার যৌন ঈর্ষারই নামান্তর। প্রাতিষ্ঠানিক সংকীর্ণতা তাঁর মনের সমস্ত মানবিক সুকুমার প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু এমনটা স্থবিরের ক্ষেত্রে হয়নি। অন্যদিকে নির্বাণও নিজেকে সরিয়ে দিতে পারেনি ইতির থেকে।শেষে ইতির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল।আর অলক্ষ্যে এই দৃশ্য দেখে 'দুর্বার ক্রোধে আলোড়িত' হল উচন্ড।সে ভাবল মার পরাভূত হয়নি।সঙ্ঘ অশুচি হয়েছে।এবার বুদ্ধের ক্রোধে সব লয় প্রাপ্ত হবে।

    পরদিন সকালে নির্বাণের ডাক পড়ল এবং সে নিজেই স্বীকার করল যে সে সঙ্ঘের ধর্ম চ্যুত হয়েছে তাই তাকে যেন দন্ডবিধান করা হয়।স্থবির কম্পিত স্বরে বলল যে ভুল তাঁরই বেশি কারণ সেই তাঁকে সঙ্ঘে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু উচন্ড চায় তাকে চরম শাস্তি দিতে।স্থবিরের সংবেদনশীল মানবিক মন কোন দন্ড বিধান করতে দ্বিধান্বিত হল।তখন উচন্ডই এই মর্মে শাস্তি ঘোষণা করে ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করল যে সঙ্ঘের খাদ্য ও পানীয়তে তার কোন অধিকার আর থাকল না।তাকে সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কার করা হল।স্থবিরে হৃদয় করুণায় বিগলিত হল পনেরো বছর আগের কথা ভেবে যখন দু'জন শিশুকে সে কোলে টেনে নিয়েছিল।নীরবে অশ্রু মোচন করল।নির্বাণ ও ইতি পাড়ি দিল অজানার উদ্দেশে - "ঊষালোক ফুটিবার সঙ্গে সঙ্গে ইতি ও নির্বাণ সঙ্ঘ হইতে বিদায় লইল।সঙ্ঘের পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া দুইজনে হাত-ধরাধরি করিয়া নিরুদ্দেশের পথে বাহির হইয়া পড়িল।কোথায় যাইতেছে তাহারা জানে না ; এ যাত্রা কিভাবে শেষ হইবে তাহাও অজ্ঞাত।কেবল,উভয়ের বাহু পরস্পর দৃঢ়নিবদ্ধ হইয়া আছে,দুস্তর মরু-পথের ইহাই একমাত্র পাথেয়।"

    এরপর উচন্ড যখন স্থবিরকে জিঞ্জাসা করলেন পাতিমোক্ষ মতে ভিক্ষুর দন্ডবিধান অনুচিত কিনা ও তাদের প্রতি আদৌ কোন করুণা করা যায় কিনা।স্থবির শুধু বলল যে বুদ্ধের ইচ্ছা দুরধিগম্য।পাতিমোক্ষ তাঁর ইচ্ছা কিনা তা জানি না।তখন উচন্ড দু'হাত আকাশে তুলে গভীর কন্ঠে বলল যে - বুদ্ধ তাঁর নিজ ইচ্ছা প্রকাশ করুক।সমস্ত সংশয় নিরসন করে বজ্রালোকে সত্যের প্রদর্শক হোন।তখনই মধ্যাহ্ন বাতাস ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল ও আবার প্রচন্ড ঝড় শুরু হল।যেমনটা পঞ্চাশ বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল।স্থবির বুঝল বুদ্ধের ইচ্ছা।ভয়ার্ত হয়ে উচন্ড থের'র জানু ধরে বলতে লাগল যে আমিই কি ভুল করেছি।আমার পাপেই কি সঙ্ঘ ধ্বংস হয়ে যাবে।এটাই বুদ্ধের অলৌকিক ইঙ্গিত ? চারিদিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকার নেমে এলো। অনুশোচনায় দগ্ধ হল উচন্ড ও এই বলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন যে - '' 'আমি যাইব।তাহাদের ফিরাইয়া আনিব --তাহাদের ফিরাইয়া আনিব --' "।তাঁর সমস্ত চিৎকার ডুবে গেল।সঙ্ঘ নিমজ্জিত হল। স্থবির শীর্ণ প্রাচীন কন্ঠে বলল যে - ' সে গোতম , অনন্তকালে আমাকে চক্ষু দাও।তমসো মা জ্যোতির্ময় --...'

 প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় স্থবিরতাকে মানেনি দু'জন নরনারী। তাঁরা একে অপরকে ভালোবাসেছে।মরু ও সঙ্ঘ আসলে প্রেমহীন,সংবেদনহীন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।যেখানে নির্বাণ ও ইতি অপাপবিদ্ধ ফুলের মত।যেমন রক্তকরবী'র যক্ষপুরীর নন্দিনী। যাঁদের মনে পাপ,ঈর্ষা,লোভ নেই। কিন্তু যা আছে ধর্মের রক্ষকের মধ্যে।যে বুদ্ধ করুণা,মৈত্রী ও অহিংসার বাণী ছড়িয়ে ছিলেন তাঁরই সঙ্ঘে কার্যক্ষেত্রে করুণা,প্রেমের চরম অবমাননা ঘটল।নির্বাণ নামটিও ব্যঞ্জানাবহ।নির্বাণ অর্থাৎ মুক্তি।সে মুক্তি খুঁজে পেল কোন কল্পিত দেবতাকে ভালোবেসে নয়, মানুষকে ভালোবেসে।লক্ষ্যনীয় বুদ্ধও সুজাতার হাতের পরমান্ন খেয়েই মোক্ষ পেয়ে ছিলেন।এই জ্যোতির্ময় আলো আসলে সংকীর্ণতা, কুটিলতা থেকে উত্তরণের আলো। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন প্রেমই 'পথের আলো'। শিল্পী শরদিন্দু বুদ্ধ'কে খুঁজেছেন কোন দেবলোকে নয়,মানবলোকে।



তথ্যসূত্র :

১. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র, আনন্দ,একাদশ সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১২, পৃষ্ঠা - ১১ -২৪, ১৬৪-১৭৫, ১৮৪-১৯৬ ।










      


Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন